বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০২০

ঠিক কবিতা ৯ : দেবব্রত রায়

 


 


পুণ্যতোয়া একটি নদীর নাম 


দেবব্রত রায়  


৹ গতকাল ৹


                          .           মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে রফিকুল মধুমিতা সনত অলোকেশ আমরা সবাই পুণ্যতোয়ার তীরে অঝোরে ভিজলাম! আমাদের সাথে নিরবে ভিজেছিল বট অশ্বত্থ নিম আর, হরিতকীর জঙগল ! বুড়িভৈরবীর শ্মশান, আমাদের ইস্কুল, ফুটবলমাঠ, আদিগন্ত চরাচর জলসই হতেই ,  ঘাসের আশ্রয় থেকে ফড়িং, উবুইয়ের দল উদ্বাস্তুর মতোই  বেরিয়ে এসেছিল,খোলা আকাশের নীচে! যেন একটা দীর্ঘ মন্বন্তরের পর  ভোজের উৎসবে রবাহূত  কাক, শালিকের দল 'রাক্কুসে' খানসেনাদের মতোই,ঝাপিয়ে পড়েছিল  সেইসব নরম শরীরের দখল নিতে !  
 বিরানব্বইয়েও পোক্ত সুরবালা বলেছিল, দ্যাশ থিইক্যা পলাইয়া আসনের সময় বিধম্মীগো হাতে ধম্ম খোয়াইলাও, পুণ্যতোয়ার ছোঁয়ায় তেঁহাদের  হগগলেরই গোলোকপ্রাপ্তি হইসে ! 
                 আমার" স্বদেশী " ছোট কাকা শুনে  বলেছিলেন,    জানি না, এইযে গুচ্ছশেকড়ের শরীর জুড়ে কতশত ভালোলাগা, অভিমান,গলা বুজেআসা- ব্যাথা লেপ্টে  রয়েছে.... 
তারা কী,এসবকিছুই বাসি কাপড়ের মতো ফেলে  রেখে  মাধ্যাকর্ষণের চেয়েও একটি তীব্র টান পার হয়ে গোলোকধামে পৌঁছোতে পারে ! 
        যে বয়সটা আমাদের অনেককিছুই জানার জন্য যথেষ্ট  নয় ,ঠিক সে-বয়সেই,  মধুমিতা, অলোকেশের ছোড়দি, ফুলপিসি, আমার রাঙা কাকীমাকে প্রজাপতির মতো একটি রঙিন  ডানামেলা জীবন বাকী রেখেই  অজানা গোলোকধামে কেন চলে যেতে হয় ! 
             আমাদের  এই পাখিগ্রাম, ফুটবলমাঠ, পুণ্যতোয়া,  বট, অশ্বত্থ, নিম, হরিতকী জঙগলের চেয়েও কি সুন্দর সুরবালার গোলোকধাম! সেখানে কি শুধুই , ভাঁড়ে ভাঁড়ে অমৃত সাজানো থাকে, নৃত্যগীত আর, তুলতুলে-নরম পালকের বিছানায় অফুরান-আনন্দ শরীর জড়িয়ে থাকে মায়ের ওমের মতো  ! মধুমিতার মৌমাছি-নৃত্যের চেয়েও কি ভালো নাচে ওখানের মেয়েরা!  
গতকাল আমাদের কাদামাখা  ফ্রক প্যান্ট-শার্টগুলো পুণ্যতোয়ার স্রোতে জড়াজড়ি করে হুটোপুটি আর,ডুব সাঁতারের কাছেই শিখেছিল , এর চেয়ে সুখ আর কিছুতেই নেই !     


 ৹ আজ ৹
              

                              বুধবার  মধুমিতার বিয়ে! অলোকেশ যাবে না। ওর রেস্তোর অভাব! ( না-কী, অন্যকিছু!) রফিকুল বাংলাদেশের কবিতা মেলায়! সনতের সঙ্গে আমাদের কারোরই আর যোগাযোগ নেই!  ও এখন কুলিটিলায় ফুলটুসির ঘরে রাত্রি কাটায়! আমি ব্যারাকপুরে...... 
অনেকদিন পর একটা মৃত্যুর খবর পেয়ে পুণ্যতোয়ার তীরে এসে দাঁড়ালাম! সনতের নিভে যাওয়া চিতা দায়হীন আবর্জনার মতোই ভেসে গেছে রাক্ষুসি নদীর স্রোতে !  বৃক্ষহীন,ফসলহীন  এই  ভূমি, বৃষ্টিরোহিত এই আকাশ, পুণ্যতোয়ারও যেন কোনো দায় নেই একসময়ের দুরন্ত ফুটবলার সনতের প্রতিটি আত্মহত্যাকে স্মরণে রাখার!
          নির্জন দুপুরে পুণ্যতোয়ার পাড়ে এসে দাঁড়াতেই, নজরে পড়লো , কয়েকটা কুকুর আর, কাকের দঙগল যেন কীসের মীমাংসা নিয়ে  ভীষণ ক্রুদ্ধ !  মনে হলো,ওরা বিদ্রোহী সনতের মৃত্যুবিষয়ক আলোচনায় বট নিম অশ্বত্থ আর,পুণ্যতোয়ার এই অবহেলার  বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ-সভা ডাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে  ! 
সেই সোরগোল থেকে অনেকটাই  দূরে , আটপৌরে একটি মেয়েকে দেখলাম ঘাটের কিনারায় উদাস তাকিয়ে  আছে  বহু দূরে বিন্দুর মতো ধীরেধীরে একটি নৌকার হারিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করে! কেন জানি না, আমার মনে হলো ,এই মেয়েটিই সনতের ফুলটুসি ! আমি পাড় থেকে  ওর পাশ দিয়েই ঘাটে নেমে এলাম !  কিন্তু, মুহূর্তের জন্য  মেয়েটি আমার দিকে ফিরেও দেখলো না! আমি সেই বিষন্ন রঙের মেয়েটির ছায়া এড়িয়ে পুণ্যতোয়ার জলে নামতেই  বুঝলাম , আমার মাথার উপরের ঘোলাটে আকাশ, এই পুণ্যতোয়া আমাদের নয়!  মৃত শালিকের মতোই বিষন্ন দুপুরের এই আলো, পুণ্যতোয়ার এই ভীরু স্রোতকে আমি  চিনি না!   


৹ আগামীকাল ৹


            সময়ের সাথে সাথে পুণ্যতোয়া তার ডেনসিটি  হারিয়ে  ক্রমশ অসারেই বেড়েছে! আমাদের স্কুল, খেলার মাঠ, ভৈরবির শ্মশান, আমাদের পাখিগ্রাম, সবকিছু গ্রাস করে একটা  পাইথনের মতোই ভরা পেট নিয়ে পড়ে আছে পুণ্যতোয়া নামের একটি পৃথুলা নদী ! এক সময়ের A4-সুন্দরী এখন যেন আ অল ডিভারিং  ওল্ড লেডি   ! রিসেন্টলি আমাদের শুধু  নামের গ্রামখানি পরিবর্তনের ঝোড়ো হাওয়ার গতিতে একটি রয়্যাল সিটি হয়ে উঠছে! যেন স্পিডোমিটারের সর্বোচ্চ ইনডেক্স ছুঁয়ে বিল্ডআপ করেছে  করপোরেট অ্যাপার্টমেন্টগুলো ! এয়াররুটগুলোকেও তথষ্ট রেখে নিত্যনতুন  মাথা তুলেছে জায়গান্টিক টাওয়ারস !এসব দেখলেই মনে হয়, যেন সুরসাধনার মাঝে বুলডোজার, ক্রেন, জেসিবি  যন্ত্র-অসুরের রুড ইনভেসন !এ যেন সবকিছু লয় করার জন্যই অরণ্য-প্রকৃতির বিরুদ্ধে  প্রলয়ছন্দের একটা অসহ্য বিদ্রোহপনা  ! এখানে রাত্রিহীন টাওয়ারের মাথায় চাঁদ ওঠে লোহার তাওয়ার মতোই !চব্বিশঘন্টা নিজের চামড়ার ছেঁচকি পোড়া দুর্গন্ধ সহ্য করেও মানুষ  তার নাশারন্ধ্রের  বিশেষ গুণটির জন্যেই বোধহয়,   আজও কোনোক্রম বেঁচেবর্তে আছে  নইলে,এই পুঁতিময়দুর্গন্ধে সে কবেই নিজেকে হত্যা করতো  ! এখানে ক্লান্তির মুহূর্তে  আর ক্লোরোফিলের আশ্বাসটুকুও পাওয়া যায় না কারণ, এখানে কোনো গাছপালা নেই ! যেহেতু, গাছপালায়-ই নেই তাই, এখানে কোনো পাখিও নেই!  পাখিদের সুর হীন, ক্লোরোফিল হীন একটা আনপ্রোডাক্টিভ ল্যান্ডের বাসিন্দা আমরা !                             
                আমার বাড়ি থেকে একটি ওয়াকিং ডিস্টেন্সে "আনন্দি কফি শপ"! সেখানে মাঝেমধ্যেই প্রোফেসর সাংভি-র সঙ্গে দেখা হলে আমাদের গল্প হয়। আমি খবর নিই তার নী-ট্রান্সপ্লান্টের বিষয়ে।সেও জিজ্ঞেস করে, আমার এনজিওগ্রামের খবর কী ?  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন